নিজস্ব প্রতিবেদক ১৩ জুন ২০২১ , ১:১০ এএম প্রিন্ট সংস্করণ
মোঃ মোয়াশেল ভূঁইয়া
ধরে নিচ্ছি, এমন উত্তেজিত মুহূর্তে আপনি বিতর্কে গেলেন। আপনি তার মতামতের বিপক্ষে অকাট্য তথ্যনির্ভর যুক্তি উপস্থাপন করলেন। কিন্তু, শুধু গলার জোরে যুক্তির ভিতটা দুর্বল করা যায় না। দরকার তা খণ্ডনের জন্য তার চেয়েও জোরালো যুক্তি। তারপরও ধরে নিলাম, আপনি আপনার বুদ্ধিমত্তায় প্রকাশিতব্য বিষয়ে তার চেয়েও জোরালো যুক্তি প্রয়োগ করে খণ্ডনও করতে পারলেন। প্রকারন্তরে আপনি প্রমাণ করতে পারলেন যে, তার ধারণা, তার মতামত ষোল আনাই ভুল। যেহেতু যুক্তিহীন কথা বাজারেও চলে না। তাই বলে কিন্তু প্রতিপক্ষ চুপ থেকে ভদ্রোচিত ভাবে নীরব শ্রোতা ছিলেন না? তবে একচোট বাকবিতণ্ডা যে হয়ে গেল এটা আর বুঝার বাকী নেই।
তবুও আপনি জেতার আনন্দে একেবারে আপাদমস্তক উল্লসিত। তবে আসল কথা এই, যে কোন বিতর্কের শেষ পরিণতিতে দু’পক্ষই থাকে অটল, অনড়। তারা আরো জোরালোভাবে গলা উঁচিয়ে বলে থাকেন তার কথাটাই সঠিক। তাই বলছি, বিতর্কে হেরে গেলে তো হেরেই গেলেন। কিন্তু আপনি জিতলেও হারবেন। কারণ, জেতার আনন্দে আপনি হয় তো জোশ-মুডে হৃদয় আকাশে আতশবাজি পুড়াচ্ছেন। কিন্তু? ঐ ব্যক্তির মনের অবস্থা কী রকম হতে পারে ভাবা যায়? ভুল প্রমাণ করাতে গিয়ে আপনি তাকে ছোট প্রমাণিত করেছেন। তার অহমিকায় আর আত্মসম্মানের ওপর আঘাত করেছেন। এমতাবস্থায় সে কী মন থেকে আপনার জয় মেনে নেবে? কখনো না। আপনি হয় তো ভাবছেন, ঐ ব্যক্তি তার মতামত বা ধারনার পরিবর্তন করেছে। কিন্তু আসলে তা নয়। আপনি কোনভাবেই তার নিজস্ব মতামত থেকে তাকে একচুল পরিমাণও নড়াতে পারেন নি। বাস্তবতা এই যে, বিতর্কে মানুষের মতামতের স্বপক্ষের বা বিপক্ষের যুক্তিকে খণ্ডন করা যায় বটে। কিন্তু তার বিশ্বাসের পরিবর্তন করা যায় না কখনো । কারণ,এ পৃথিবীতে সাধারণ মানুষই কেবল নয়, প্রায় ক্ষেত্রেই শিক্ষিত মানুষও অপরিসীম ভ্রান্ত বিশ্বাস আর সংস্কারের নিগড়ে আবদ্ধ থাকে। তাদের মতাদর্শের বাইরে কোন যুক্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিও তাদের সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধ বা বিশ্বাস নেই। এমন কী সাধারণ কোন ব্যক্তিকেও তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু মেনে নিতে বাধ্য করালেও কিন্তু সে তার মত পাল্টায় না। যেহেতু আপনি তার অনুভূতিতে আঘাত করেছেন। তাছাড়া, মতবিরোধ এমন একটা বিষয় এটা নিয়ে যতই বিতর্ক চলুক না কেন। কিংবা মুখে যতই নমনীয় ভাব দেখাক না কেন। এতে তাদের ইস্পাত কঠিন হৃদয় এতটুকুনও টলে না। মূল কথা, বিচার মানি তবে তালগাছটা আমার!! মতবিরোধ বিতর্ক খুব স্পর্শকাতর একটা বিষয়। তাছাড়া, আমাদের সমাজে খুব কম সংখ্যক লোকই যুক্তি মেনে চলে। সাধারণত বেশির ভাগ মানুষই হুজুগে বিশ্বাসী, একরোখা আর একপেশে।
আসলে, আমাদের সমাজে দুই ধরনের মানুষকে পরাজিত করা কঠিন। এক–যে বোঝে না যে, সে আসলেই কম বুঝে। দুই–বোঝেও না বুঝার ভান করা।” এক নং কারণের পরিপ্রেক্ষিতেই হয় তো সক্রেটিস একবার তাঁর সময়কালের এক আত্মম্ভরি স্বঘোষিত জ্ঞানীর উদ্দেশ্য বলেছিলেন, “তোমার সঙ্গে আমার পার্থক্য এখানে যে, আমি যে মূর্খ তা আমি জানি। কিন্তু তুমি যে মূর্খ, তুমি সেটাও জান না।” আর দুই নং প্রসঙ্গে বলছি, কেউ না বুঝার ভান করে ইচ্ছে করে। কারণ, সে নিজেও জানে তা সঠিক আর এ জানাটাই তার বড় সমস্যা। অন্যের মতাদর্শের প্রতি সাপোর্ট করা মানে তার কাছে হেরে যাওয়া। আর এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। আবার কেউ হঠাৎ নেগেটিভ মন্তব্য বলে ফেলায় তা আর ফেরাতেও পারছে না, তার অহংভাবের কারণে। অর্থাৎ তাই তিনি তার মতাদর্শে অবিচল, অনড় থাকেন। তবে এটা মানুষের একটা সহজাত প্রবৃত্তিও বটে। তাই তো অধ্যাপক ওভারস্ট্রীট তাঁর বই “ইনফ্লুয়েন্সিং হিউম্যান বিহেভিয়ার”–এ বলেছেন, “না” কথাটা একবার বললে তাকে কাটানো কঠিন কাজ। কোন লোক “না” বললে তার সব আত্মঅহমিকা তাকে ওটাই আঁকড়ে থাকতে বলে। সে হয়তো পরে বুঝতে পারে ‘না’ বলাটা ঠিক হয়নি। তা সত্ত্বেও তার অহমিকাই তাকে তার মত বদলাতে দেয় না।”
সত্যটা এই যে, প্রতিবাদ করে, যুক্তিতর্ক প্রয়োগ করে জয় হয় বটে তবে তা তিক্ততায় ভরা। এটা মূলত ভেতেরে ভেতরে একটা দীর্ঘস্থায়ী বিরোধের সৃষ্টি করলেন। আর এতে করে আপনার পরিমার্জিত ব্যক্তিত্ব ও ইমেজ কিছুটা হলেও সুধী মহলে যে তা সমালোচিত হবে এটাও সত্য। তাছাড়া আপনি সাময়িক আনন্দ পেলেও আপনার চিত্তের শান্তি বিঘ্নিত হবে নিঃসন্দেহে। কারণ,আপনার ভেতরে ক্ষোভের বীজটা আপনি নিজেই রোপন করে তা সযতনে পেলেপুষে রাখছেন। কেননা, মানুষ আঘাত ভুলে গেলেও অপমান সহজে ভুলে না। ফলে তাকে দেখলেই আপনার মনেও নির্ঘাত একটা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হব