আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, সুপ্রিয় পাঠক বৃন্দ। আজ আমাদের আলোচনার বিষয় হচ্ছে বিনা হিসাবে জান্নাতে যাওয়ার দোয়া সম্পর্কে। হাদীসে অনেক ধরনের দোয়া রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিনা হিসাবে জান্নাতে যাওয়ার দোয়া। হাদিস শরীফে এমন কিছু দোয়া আল্লাহ রাসুল করার মাধ্যমে আমাদের হিসাব সহজ হতে পারে এবং সহজে জান্নাত লাভ করা যেতে পারে। চলুন দেখে নেওয়া যাক বিনা হিসাবে জান্নাতে যাওয়ার দোয়া গুলো কি কি।
বিনা হিসাবে জান্নাতে যাওয়ার দোয়া
অনেক সময় ফেসবুকসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতে বিনা হিসাবে জান্নাতে যাওয়ার দোয়া শিরোনামে এই দোয়াটি দেখা যায়,
اللهم اني اسالك الجنه بغير
দোয়াটি রেফারেন্স হিসেবে দেওয়া থাকে মুসনাতে আহমাদ।
জেনে নেওয়া জরুরী এই দোয়াটি হাদিসের দোয়া নাকি আরবি কোন বাক্য এবং বিনা হিসেবে জান্নাত পাওয়ার হাদীসে উল্লেখিত কোন দোয়া থেকে থাকলে সেটিও জানতে পারবো।
উত্তর- উপরের দেওয়া দোয়াটি সরাসরি ভাবে হাদিসে বর্ণিত দোয়া না বলে হাদিস থেকে উৎসাহিত বা গৃহীত আরবি দোয়া বলা যেতে পারে এবং এটি পড়াতেও অসুবিধা নেই।
দুয়ার অর্থ হচ্ছেঃ اللهم اني اسالك الجنه بغير حساب
‘’হে আল্লাহ আপনার কাছে বিনা হিসেবে জান্নাত চাচ্ছি‘’
দোয়াটি হুবহু এই শব্দে হাদিসের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে بغير حساب শব্দটি বাদ দিয়ে শুধু اللهم اني اسالك الجنة শব্দে হাদিসে প্রচুর দোয়া রয়েছে। মুসনাদে আহমাদে ১৪৮৩, ১৫৮৪, ১৫৮৯৮ ও ২৫০১৯ নাম্বার হাদিসেও اللهم اني اسالك الجنة পাওয়া যায়। তবে কোন হাদিসে সরাসরি ভাবে بغير حساب শব্দটি না থাকলেও হুবহু ভাবের পুরো দোয়াটি পড়া যাবে এতে কোন অসুবিধা হবে না ইনশাল্লাহ।
যেহেতু দোয়ার অর্থ হাদিসের সাথে সাংঘর্ষিক তো নয় বরং হাদীসে জান্নাত চাইতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে এবং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে বেশি বেশি করে জান্নাত যাওয়ার দোয়া করতে বলেছেন। আর জান্নাত যাওয়ার আরবি হলো এই দোয়া।
জামে‘ তিরমিযীর বর্ণনাঃ
হান্নাদ (রহঃ) আলাজ ইবনে মালিক রাজিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহর কাছে তিনবার জান্নাতের দোয়া করে তবে জান্নাত তখন বলে, হে আল্লাহ! ‘একে জান্নাতে দাখিল করে দাও। ‘আর কোন ব্যক্তি যদি জাহান্নাম থেকে তিনবার পালা যায় তবে জাহান্নাম বলে, ‘ হে আল্লাহ! একে জাহান্নাম থেকে পানা দিয়ে দাও।’ জামে‘ তিরমিজি।
আরও পড়ুন: গান বাজনা সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসে ব্যাখ্যা
_হাদিস নং – ২৫৭২
বিনা হিসাবে ৭০ হাজার অনুমতিকে আল্লাহ তায়ালা জান্নাত দেবেন এই মর্মে মুসলিমের হাদীসে পাওয়া যায়।
সে মোতাবেক بغير حساب যোগ করে পুরো দোয়াটি পড়লে উভয় হাদিসের উপরেই আমল হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ।
حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ سَلاَّمِ بْنِ عُبَيْدِ اللَّهِ الْجُمَحِيُّ، حَدَّثَنَا الرَّبِيعُ، – يَعْنِي ابْنَ مُسْلِمٍ – عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ زِيَادٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ” يَدْخُلُ مِنْ أُمَّتِي الْجَنَّةَ سَبْعُونَ أَلْفًا بِغَيْرِ حِسَابٍ ” . فَقَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللَّهِ ادْعُ اللَّهَ أَنْ يَجْعَلَنِي مِنْهُمْ . قَالَ ” اللَّهُمَّ اجْعَلْهُ مِنْهُمْ ” . ثُمَّ قَامَ آخَرُ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ ادْعُ اللَّهَ أَنْ يَجْعَلَنِي مِنْهُمْ . قَالَ ” سَبَقَكَ بِهَا عُكَّاشَةُ ” .
আব্দুর রহমান ইবনে সাল্লাম ইবনে ওবায়দুল্লাহ জুমাহী (রহঃ) আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত যে, নবীজি সাঃ বলেছেন, আমার উম্মতের ৭০ হাজার লোক হিসাব ছাড়াই জান্নাতে প্রবেশ করবে। জনৈক সাহাবী বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি আল্লাহ্র কাছে দোয়া করুন যেন তাদের আমাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম দোয়া করলেন, ইয়া আল্লাহ! ওকে এদের অন্তর্ভুক্ত করে নিন। তারপর আরেকজন সাহাবী দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার জন্য ও আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। যেন আমাকেও তাদের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেন। এই সুযোগ লাভে উক্কাশা তোমার অগ্রগামী হয়ে গেছে। (সহীহ মুসলিম)
_হাদিস নং- ৪১৩
উত্তর দিয়েছেনঃ হাফেজ মাওলানা শুআইব মাহদী মাহী
মুহাদ্দিস, ‘মুসলিম বাংলা’ হাদীস বিভাগ।
কারা বিনা হিসেবে জান্নাতে যাবেন?
বিনা হিসেবে কারা জান্নাতে যাবে এবং তাদের আমল কি হবে এই সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীর্ঘ এক হাদীসের বর্ণনা করেছেন। উক্ত হাদিসে উঠে এসেছে- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের সামনে হাদিসটি বর্ণনা করছিলেন, ‘ আমার কাছে সব (নবীর) উম্মত পেশ করা হলো। আমি দেখলাম কোন নবীর সঙ্গে কতিপয় (৩ থেকে ৭জন) অনুসারে রয়েছে। কোন নবীর সঙ্গে এক অথবা দুইজন অনুসারী রয়েছে। কোন কোন নবীর সাথে দেখলাম কেউই নেই।
এমন সময় অনেক বড় একটি জামাত আমার সামনে পেশ করা হবে। আমি মনে করলাম এটি আমার উম্মত। কিন্তু আমাকে বলা হলো যে এটা হল হযরত মুসা আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার উম্মতের জামাত। কিন্তু আপনি অন্য দিগন্তের দিকে তাকান। অতঃপর আমি অন্য দিগন্তে তাকাতেই আরো বড় একটি জামাত দেখতে পেলাম।’ আমাকে বলা হলো এটি আপনার উম্মত। আর তাদের সঙ্গে রয়েছে এমন ৭০ হাজার ব্যক্তি যারা বিনা হিসেবে এবং আজাব ভোগ করা ছাড়াই জান্নাতে প্রবেশ করবে।
জান্নাতুল ফেরদৌস লাভ করার ৭ টি আমল – বিনা হিসাবে জান্নাতে যাওয়ার দোয়া
প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলিম প্রত্যাশা করে থাকে তার মৃত্যুর পরবর্তী জীবন হোক জান্নাত বা শান্তির জায়গা। এর প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ’যখন তুমি জান্নাত চাইবে তখন জান্নাতুল ফেরদৌস চাও। কারণ এটি একটি জান্নাতের মধ্য থেকে সবথেকে উত্তম জান্নাত।’ পবিত্র কুরআনে সূরা মুমিনুনে আল্লাহ তায়ালা বলে দিয়েছেন যে, সাতটি আমল করলে যে কোন মানুষ জান্নাতুল ফেরদৌস এর ওয়ারিশ তথা উত্তরাধিকারী হবেন এবং চিরকাল সেই শান্তিময় আবাসস্থলে থাকবেন। সুরা মুমিনের এক থেকে দশ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এই সাতটি কাজের কথা বলেছেন।
চলুন জেনে নেওয়া যাক জান্নাতুল ফেরদৌসের অধিকারী হওয়ার জন্য আমাদের কি কি কাজগুলো করতে হবে। এক কথায় জান্নাতুল ফেরদৌস লাভ করার দোয়া বা বিনা হিসাবে জান্নাতে যাওয়ার দোয়া।
১। জান্নাতুল ফেরদৌস লাভ করার জন্য প্রথম শর্ত মুমিন বা ঈমানদার হতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা, আল্লাহর প্রেরিত নবীগণ, ১০৪ খানা আসমানি কিতাব, কিয়ামত বা বিচার দিবস এবং জান্নাত ও জাহান্নামের উপর বিশ্বাস থাকা লাগবে।
২। খুশু-খুঁজু বা আল্লাহ তায়ালাকে হাজির নাজির জেনে নিয়মিতভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে হবে। লোক দেখানোর নামাজ আদায় করলে তা আল্লাহর দরবারে কখনোই কবুল হবে না বরং এ ধরনের নামাজীদের জন্য ধ্বংস ও জাহান্নামের শাস্তি অপেক্ষা করছে। (সুরাঃ মাউন)
৩। অপ্রয়োজনীয় বা বেহুদা অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪। যাকাত আদায়ের তৎপরতা থাকতে হবে।
৫। লজ্জাস্থানের হেফাজত করতে হবে। রাসুল সাঃ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের জিব্বা ও লজ্জাস্থান এর হেফাজতের দায়িত্ব নেবে আমি তার জান্নাতে দায়িত্ব নেব।‘
৬। নামাজের হেফাজত করতে হবে। অর্থাৎ প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এর ফরজ নামাজগুলো জামাতে খুশু-খুজুর সাথে আদায় করতে হবে। ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ কাযা না করা।
৭। আমানত রক্ষা করা। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক ব্যক্তি দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। একজন ঈমানদার ব্যাক্তির কাছে বড় আমানত ইসলাম।
এছাড়া অর্থ সম্পদ সন্তান স্ত্রীগণ ও শিক্ষা এসব কিছুই তার জন্য আমানত। আর সব আমানতের যথাযথ সংরক্ষণ করে রাখা একজন ঈমানদার ব্যক্তির জন্য কর্তব্য স্বরূপ।
উপরে লিখিত কাজগুলো বিশ্বাসের সাথে যথাযথ নিয়মে আদায় করলে আপনিও জান্নাতুল ফেরদৌসের হতে পারেন ইনশাআল্লাহ। এ সম্পর্কিত অনুবাদ ও ব্যাখ্যা দেখতে পারবেন পবিত্র কুরআনের সূরা মুমিনুরের ১-১১ আয়াতে।